ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

সোনা মিলছে হুন্ডির টাকায়

golআমদানি নীতিমালা নেই, সব ক্রয় অবৈধ পথে, মজুদ সব সোনাই অবৈধ

অনলাইন ডেস্ক :::

বৈধ পথে সোনা আমদানির কোনো নীতিমালা না থাকায় দেশের জুয়েলারি বাণিজ্য পুরোপুরি চোরাচালাননির্ভর হয়ে পড়েছে। হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হাজার হাজার কোটি টাকায় টন টন সোনা আসছে চোরাচালানে। সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের হাত ঘুরে সেই সোনা পৌঁছে যাচ্ছে দেশের আনাচকানাচে, তিন সহস্রাধিক জুয়েলারি দোকানে। বিরাট এ বাণিজ্যের নেটওয়ার্ক সচল থাকলেও সরকার সেখান থেকে কোনো শুল্ক বা কর পাচ্ছে না। দেশ বঞ্চিত হচ্ছে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব থেকে। স্বর্ণালঙ্কার বেচাকেনা বৈধ হলেও দেশে সোনা প্রাপ্তির কোনো উৎস নেই। দেশে সোনার খনি নেই, অন্য কোনো উপায়ে উৎপাদনও হয় না। এমনকি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে দোকানিরা বৈধ পথে সোনা আমদানিও করতে পারেন না। কেবল বিদেশ থেকে দেশে আগতরা সর্বোচ্চ ১০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালঙ্কার আনতে পারেন। ফলে স্বর্ণালঙ্কারের দেশীয় চাহিদা মেটাতে জুয়েলারি ব্যবসায়ীদের সোনা চোরাকারবারিদের দ্বারস্থ হতে হয়। দেশে বৈধভাবে কোনো ধরনের সোনার চালান আমদানি না হলেও জুয়েলারি ব্যবসা চলছে রমরমা। চোরাকারবারির মাধ্যমে সংগ্রহ করা সোনা ও অলঙ্কারে চলছে জুয়েলারি ব্যবসা।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) সভাপতি ও ভেনাস জুয়েলার্সের স্বত্বাধিকারী গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, নীতিমালা না থাকার কারণে সরকার প্রতি বছর হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর কাছে তিন দফা প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি। ন্যূনতম কর প্রদান সাপেক্ষে কমপক্ষে ১০ কেজি স্বর্ণবার আমদানির অনুমতি, কাস্টমস ডিউটি ৩ হাজার থেকে কমিয়ে শিল্প ব্যবসায়ী পর্যায়ে ১ হাজার টাকা ও সাধারণ ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ হাজার টাকায় আনা, স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করা এবং স্বর্ণশিল্প স্থাপন প্রক্রিয়া সহজ করার ওপর জোর দেন সভাপতি। গঙ্গাচরণ মালাকার বলেন, পাশের দেশ ভারত তাদের দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের চাহিদা অনুযায়ী সোনা আমদানি করে জুয়েলার্স মালিকদের মধ্যে বিতরণ করে। ফলে এ খাত থেকে বিপুল রাজস্ব পায় ভারত সরকার। বাংলাদেশের স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও দ্রুত এ ধরনের একটি নীতিমালা ও এর বাস্তবায়ন চান। অতিসম্প্রতি বাজুসের এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সোনা আমদানি-সংক্রান্ত নীতিমালা তৈরির আশ্বাস দিয়েছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বড় আকারের যে সোনার চালানগুলো আটক হচ্ছে, এর অধিকাংশই অন্য দেশে পাচারের জন্য আনা হয়ে থাকে। এসব চালানের সঙ্গে ভারতের একাধিক চোরাকারবারি চক্র সরাসরি জড়িত বলে সোনা চোরাচালান মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। কিন্তু দেশকে সোনা পাচারের করিডর বানিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আরেকটি সংঘবদ্ধ চক্র চোরাচালানের একটি অংশ হাতিয়ে দেশের বাজার রমরমা রাখছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এ চক্রের সদস্যরা রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের ও প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ক্ষমতায় রীতিমতো রাঘব-বোয়ালে পরিণত হয়েছেন। বনানী ধর্ষণকাণ্ডের সূত্র ধরে প্রভাবশালী ওই চক্রের আদ্যোপান্ত সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা।

আপন জুয়েলার্সের একটি প্রতিষ্ঠান থেকেই সাড়ে ১৫ মণ অবৈধ সোনা জব্দ করে মামলা করেছে শুল্ক গোয়েন্দা। প্রতিষ্ঠানটির মালিক দিলদার আহমেদ সেলিম নিজেকে রক্ষা করতে প্রভাবশালী বিভিন্ন পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ করেও সুবিধা করতে পারছেন না। এ কারণে রাগে-দুঃখে তিনি ঢাকার আরও দুই ডজন রাঘব-বোয়ালের সন্ধান দিয়েছেন শুল্ক গোয়েন্দাদের। তার দেওয়া তথ্যসূত্র ধরে ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দারা দেশে গুটিকয় ব্যবসায়ীর হাতে শত শত মণ সোনা মজুদ থাকার অতিগোপন তথ্য আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। এসব রাঘব-বোয়ালের স্বর্ণগুদামে কখন কীভাবে হানা দেওয়া হবে তা নিয়ে চলছে নানা পরিকল্পনা। পাশাপাশি ঊর্ধ্বতন মহলের সবুজ সংকেত পাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছেন গোয়েন্দারা।

ফের সক্রিয় হুন্ডি সিন্ডিকেট : রাজধানীতে ফের বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হুন্ডি সিন্ডিকেট। মূলত সোনা ব্যবসার অন্তরালে দেদার চলছে হুন্ডি ব্যবসা। সোনা চোরাচালানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে হুন্ডির বাণিজ্য। প্রতি বছর হুন্ডির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে, তার সঠিক তথ্য নেই সরকারের কাছেও। কারা কীভাবে হুন্ডি করছে সে তথ্যও জানে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে। দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে হুন্ডি ব্যবসা। বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংক।

রাজধানীর পল্টন-তাঁতীবাজার এলাকায় আছে হুন্ডির একটি প্রভাবশালী চক্র। পল্টনের বায়তুল মোকাররম মার্কেটের দ্বিতীয় তলার আলোচিত সোনা ব্যবসায়ী জনৈক পোদ্দার নিয়ন্ত্রণ করছেন হুন্ডি ব্যবসায়ীদের বড় একটি সিন্ডিকেট। তাদের একটি অংশ সরাসরি সোনা চোরাচালানের সঙ্গেও জড়িত। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও রাহাত মুন্সীর নয়া হুন্ডি সিন্ডিকেটের বাণিজ্য বেশ রমরমা হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবকেন্দ্রিক এ হুন্ডি সিন্ডিকেট সোনা চোরাচালানেরও অন্যতম নিয়ামক হয়ে উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশ থেকে সোনার বড় বড় চালান আমদানি করা হয়, সেখানে কেবল হুন্ডির মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকা পাঠানো সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে দুবাইয়ের সোনার মার্কেটেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি হুন্ডি চক্রের সচল বাণিজ্য। উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকার প্রতিষ্ঠিত একাধিক মানি চেঞ্জার ব্যবসায়ী এই হুন্ডি বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন। এ দেশের মানি চেঞ্জার অফিস ও শাখা কার্যালয়কে হুন্ডির টাকা লেনদেনের বুথ হিসেবে ব্যবহার করছেন তারা।

বিমানবন্দর-উত্তরা সিন্ডিকেটের চেয়েও হুন্ডি বাণিজ্যে রমরমা অবস্থান রয়েছে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজারের স্বর্ণপট্টি। অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে শুধু তাঁতীবাজার থেকে প্রতি সপ্তাহে শত কোটি টাকা বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে তাঁতীবাজারে হুন্ডি ব্যবসার গডফাদার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে সোনা ব্যবসায়ী এক ঘোষ পরিবার। সোনা চোরাচালানকে কেন্দ্র করে সিঙ্গাপুরেও চলছে রমরমা হুন্ডির ব্যবসা। শত শত বাঙালি অবৈধ এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার সেরাঙ্গন রোডের আশপাশের কয়েকটি ছোট মাঠ হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মূল টার্গেট। জায়গাটি বাংলাদেশিদের মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত। প্রতি রবিবার ছুটির দিনে সেখানে প্রবাসী বাঙালির ভিড় জমে ওঠে। এর মধ্যেই খাতা-কলম নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় হুন্ডি ব্যবসায়ীদের। উদ্দেশ্য ডলার সংগ্রহ করা।

যাচ্ছে সোনা আসছে মাদক : বাংলাদেশ থেকে ভারত ও মিয়ানমারের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্টে দেদার পাচার হচ্ছে সোনা ও হুন্ডির বৈদেশিক মুদ্রা। বিনিময়ে ভারত থেকে আসছে হেরোইন, ফেনসিডিল, ইয়াবা ও গাঁজা। বিজিবি ও পুলিশের হাতে এসব চোরাকারবারি মাঝেমধ্যে আটক হলেও থেমে নেই তাদের অবৈধ ব্যবসা। যশোর বেনাপোল হয়ে ভারতে পাচার হচ্ছে সোনা ও নারী-শিশু। বিনিময়ে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসছে মরণনেশা হেরোইন, ফেনসিডিল, মদ, গাঁজা, অস্ত্র ও বিস্ফোরক। ভারত থেকে আসা মাদকের চালান বাস, ট্রাক, ট্রেন, প্রাইভেট ও মাইক্রোযোগে যাচ্ছে ঢাকা, খুলনাসহ বিভিন্ন শহরে। পুলিশ ও বিজিবি কর্মকর্তারা পাচার ও চোরাচালান আগের চেয়ে কমে যাওয়ার কথা বললেও মাদক, সোনা ও অস্ত্র পাচার বেড়ে গেছে বলে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন।

বাণিজ্যনগরী চট্টগ্রাম মাদক, ইয়াবা ও বিদেশ থেকে আসা সোনা পাচারের প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে। ইয়াবা আসছে পাশের দেশ মিয়ানমার থেকে। আর সোনা আসছে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। এসব সোনা দেশে এসে পৌঁছার পর বেশির ভাগই বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট গলিয়ে পাচার হয়ে যাচ্ছে ভারতে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ, ওমান, কুয়েত ছাড়াও থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকেও আকাশপথে সোনার চালান আসে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, এসব চালান আসার সময় মাঝেমধ্যে ধরা পড়লেও বিমানবন্দর গলিয়ে বাইরে বেরিয়ে যাওয়া সোনা কখনো ধরা পড়ে না। বিভিন্ন সূত্রে জানানো হচ্ছে, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, মাদক ও ইয়াবার প্রধান রুট এবং সোনা পাচারের দ্বিতীয় বৃহত্তম রুট এখন চট্টগ্রাম। অভিযোগ উঠেছে, যে পরিমাণ সোনা ও ইয়াবা পাচার হয়ে আসছে, এর খুব সামান্যই আটক হচ্ছে। সোনা ও ইয়াবা পাচারকারীদের সঙ্গে এসব সংস্থার গোপন যোগাযোগ থাকার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। শুধু বাহকরা নয়, বিভিন্ন এয়ারলাইনসের ক্রুর বিরাট একটি অংশ সোনা পাচারে জড়িত থাকলেও তাদের ধরা পড়ার সংখ্যা একেবারে নগণ্য। চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে সোনার চালান। কখনো বড়, কখনো ছোট আকারের সোনার বারের এসব চালানের আগ্রাসন রোধ করা যাচ্ছে না।

পাঠকের মতামত: